‘আমরা যাইনি মরে আজো– তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়ঃ
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন– এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর’ পরে।’

জীবনানন্দ দাশের এই ‘ঘোড়া’ কবিতাটির অন্য একটা বিশেষত্ব আছে বলে মনে হয়। এটা লেখার দুই-তিন দশক পরের এক কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তর থেকে কলকাতায় নেমে এসেছিলো সংবিগ্ন একদল ঘোড়া। সেই তখন থেকেই ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র নালহীন খুরের আওয়াজ, হ্রেষাধ্বনি, টগবগানো শুনছে বাংলা গানের গলিতে পায়চারী করা অসংখ্য শ্রোতা।

বাংলা ব্যান্ড-মিউজিকের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয়-শ্রোতাপ্রিয় এককথায় বলা চলে প্রবাদপ্রতিম ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। তারা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসেছিলো বাংলা গানে এক নতুন ধারার সঙ্গীত নিয়ে। ষাটের দশকে বব ডিলানের হাত ধরে যে ‘আরবান ফোক’ ধারার প্রচলন ঘটেছিলো, মহীনের ঘোড়াগুলিকে বাংলা গানে সেই জনরারই অনুসারী বলা যায়৷ সেই সময়টাতে সারা পৃথিবীতে বব ডিলান, বিটলস, জিম মরিসনরা গতানুগতিক সংগীতবোধের বাইরে গিয়ে রাজত্ব করছিলো , কিন্তু বাংলা গান তার গতানুগতিকতাকে ছাড়তে পারছিলো না। তখনকার সময়ে শ্রোতারা রোমান্টিক সুরেলা ঘরানার গানগুলোতে এত বেশি সম্মোহিত ছিলেন যে তাঁদের পক্ষে নতুন কোনো ধারার গান গ্রহণ করা সম্ভবই ছিলোনা। এইসবকে ভাঙ্গতে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সেসময় তাদের গানে রাজনীতি-বিপ্লব,ভালোবাসা,দারিদ্র্য,অন্যায়-অবিচার,স্বাধীনতা সবকিছুকে মিলেমিশে একাকার বানিয়েছিলো।

ছবিসুত্রঃ প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়

গৌতম চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ব্যান্ডের আদিস্রষ্টা। তিনিসহ তার ভাই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়,রঞ্জন ঘোষাল, তাপস দাস,এব্রাহাম মজুমদার, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় এই সাতজন মিলে শুরু করেছিলেন এই আন্দোলন। তাদের দল ছিলো সাতজনের তাই প্রথমে এই গানের দলের নাম ছিলো ‘সপ্তর্ষি’। ১৯৭৫ সালে ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানে পর্ণশ্রী ক্লাবে ছিলো ব্যান্ডের প্রথম শো। তারপর কোনো এক অনুষ্ঠানে হঠাৎ তাদের ব্যান্ডের নাম “গৌতম চ্যাটার্জি বিএসসি অ্যান্ড সম্প্রদায়” হয়ে গেলো। এরপর একদিন আড্ডায় ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য রঞ্জন ঘোষাল জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ কবিতাটি পড়ে “মহীনের ঘোড়াগুলি” নামটি প্রস্তাব করেন এবং সবাই এই নামটিকেই গ্রহণ করে নেন। গৌতম এরও আগে ৬০ এর দিকে কলকাতার বিভিন্ন হোটেলে ‘The Urge’ নামের এক ব্যান্ডে স্যাক্সোফোন বাজাতেন। তিনিই মহীনের সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের সাথে, নতুন ধরনের গানের সাথে। গীটার, স্যাক্সোফোন, ড্রামস ইত্যাদির সাথে ভায়োলিন, বাঁশি ইত্যাদির সংমিশ্রন ঘটে তার মাধ্যমেই। বাউল, রক, জ্যাজ, ব্লুজ, ল্যাটিন মিউজিক-এইসব মিশ্রণে তৈরি করলেন নতুন আরেক গানের জগৎ। লিরিক্সে,বাজানোয়,গায়কীতে ভিন্নধর্মিতা ইত্যাদি সব মিলিয়ে গানগুলোকে এমন এক রুপ দিয়েছিলেন যা ঐ সময়ের জন্য একটি বিপ্লবই ছিলো।তিনি বাঙ্গালীকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, শুধুমাত্র গিটার দিয়েও আসলে গানটা করা যায়। গৌতম চট্টোপাধ্যায় জড়িত ছিলেন নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে, কিছুদিন জেলও খেটেছিলেন। তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তা মহীনের ঘোড়াগুলির গানের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে৷

গৌতম চট্টোপাধ্যায়-ব্যান্ডের আদিস্রষ্টা। ছবিসুত্রঃ গৌরব চট্টোপাধ্যায় (গৌতম-এর ছেলে)

তৎকালীন সময়ে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র শ্রোতাপ্রিয়তা এখনকার মতো অর্থাৎ ২০০০ পরবর্তী সময়ের আবহে ছিলো না। তারা সময় থেকে এগিয়ে থাকায় গতানুগতিক শ্রোতারা তাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগে তুলে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। শুরু হওয়ার পর ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ এই ছয় বছর মাত্র মহীনের ঘোড়াগুলিকে বিচরণ করতে দেখা গিয়েছিলো। তারপর দীর্ঘসময়ের জন্য ঘোড়াগুলি ছিলো লোকচক্ষুরে আড়ালে, আস্তাবলে-যে যার জীবিকায়। ৮১ সালে ব্যান্ড ভাঙার আগের সাত বছরে তিনটা এ্যালবামে মাত্র আটটি গান,পনেরো-বিশটা অনুষ্ঠান আর রেকর্ড না হওয়া কয়েকটা গান-এইগুলোই ছিলো মহীনের ঘোড়াগুলির সম্বল। শুধু গানেই নয়, স্টেজ শো-গুলোতেও তাঁদের উপস্থাপনা ছিলো ব্যতিক্রমধর্মী৷ তাঁদের কনসার্টের টিকিটগুলো ছিলো অন্যরকম। কখনো সেগুলো ছিলো ডাকটিকিটের মতো, কখনো সেখানে থাকতো সকল সদস্যের আঙুলের ছাপ৷ পরবর্তীতে ৯০ এর দশকের শুরুতে কলকাতায় যখন অন্যরকম গান শোনার প্রচলন শুরু হয় তখন মহীনের ঘোড়াগুলির চিন্তাভাবনাগুলি নতুন প্রজন্ম নতুনরুপে গ্রহণ করেছে জেনেই ১৯৯৫ সালে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে আবারো মহীনের ঘোড়াগুলি ফিরে আসে। গত বিশ বছরে তাদের গানের অসংখ্য শ্রোতা তৈরি হয়েছিলো। যে গানগুলোকে লোকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো, গৌতম সনাতনীয় সঙ্গীত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে সে গানগুলোকেই ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে নতুন করে মহীনের ঘোড়াগুলিকে আবার সবার সামনে নিয়ে আসলেন ৷ কিন্তু এবার আর তাদের নিজস্ব এ্যালবাম নয়, গৌতম গুরুদায়িত্ব নিলেন মহীনের মিউজিক-লিরিক-সুরে সম্ভাবনাময় সব ব্যান্ড/শিল্পীদের আত্মপ্রকাশ ঘটানোর। ১৯৯৫ এর কলকাতা বইমেলায় তাদের সম্পাদিত এ্যালবাম ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ নিয়ে তার শুভসূচনা ঘটলো। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি৷ এরপর ১৯৯৯ পর্যন্ত মহীনের ঘোড়াগুলির সম্পাদনায় মোট ৪টি এ্যালবাম বের হলো। গানগুলো গণজোয়ার সবাইকে এতোই প্রভাবিত করেছিলো যে খুব অল্পদিনেই ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ কিংবদন্তী ব্যান্ড হিসেবে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলো এবং সে জোয়ার আজও বহমান।

ডিস্কোগ্রাফিঃ
স্টুডিও এ্যালবাম (১৯৭৭ – ১৯৭৯)

• ১ম এ্যালবাম ‘সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক’ গাথানি রেকর্ডস থেকে বের হয় ১৯৭৭ সালে। এই এ্যালবামটি উৎসর্গ করা হয় ধূর্জটি চট্টোপাধ্যায়কে। গাথানি রেকর্ডের পাওনা মেটানোর ব্যবস্থা হয়েছিলো টাকা ধারদেনা করে আর তাদের বান্ধবী সঙ্গীতা এবং শর্মিষ্ঠার দেওয়া তাদের মায়ের সোনার গহনা চুরির কিছু টাকা দিয়ে (রঞ্জন ঘোষালের সাথে সঙ্গীতার বিয়ে হয়েছিলো পরবর্তীতে)। মোট চারটি গানের এই এ্যালবামের (ভেসে আসে কলকাতা, মেরুন সন্ধ্যালোক, সংবিগ্ন পাখিকূল, হায় ভালোবাসি) প্রতিটা গানই ফোক-রক (আরবান ফোকের) ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত। ‘ভেসে আসা কলকাতা’ গানে তারা শহরের মিউজিকস্কেচ এঁকেছেন। ‘সংবিগ্ন পাখিকূল’ গানে একাকীত্ব ও বিহ্বলতা মিলেমিশে শূন্যতায় পরিনত হয়েছে। ‘হায় ভালোবাসি’ গানে তারা তাদের আকুলতার কথা বলেছেন,তাদের চাওয়ার কথা,ভালোলাগা-ভালোবাসার কথা বলেছেন। তাদের নৈতিক সঙ্গীতদর্শনের জলন্ত উদাহরণ এই গানগুলো।

• ‘অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব’ মহীনের ঘোড়াগুলির দ্বিতীয় এ্যালবাম। ১৯৭৮ সালে হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে কলকাতায় বের হয় দুইটি গানের (অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব, সুধীজন শোনো ) এই এ্যালবামটি। প্রথম এ্যালবামের মতোই পুরাতনকে ভেঙ্গেচূড়ে নতুন কিছু নিয়ে করার প্রচেষ্টাকে জোরালোভাবে তরান্বিত করতে পেরেছিলো এই দুইটি গানই। জ্যাজ সংমিশ্রণের গানদুইটি বাংলা গানের সেসময়ের গতানুগতিকতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলো।

• ১৯৭৯ সালে ভারতী রেকর্ডস থেকে বের হয়েছিলো ৩য় এ্যালবাম ‘দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি’। এই এ্যালবামেও মোটে দুইটি গান (এই সুরে বহুদূরে”,চৈত্রের কাফন” ) অন্তভুক্ত ছিলো । রক ধাঁচের গান ‘এই সুরে বহুদূরে’। আর ‘চৈত্রের কাফন’ রাজনৈতিক গান। নকশালের সময়ে যে বন্ধুদের ফেলে আসতে হয়েছিলো রাজপথে-গলিতে-পাচিলের ওপারে। তাদেরকে মনে করতে আর করাতেই এই গান।

কোলাবরেশন/সম্পাদিত এ্যালবাম (১৯৯৫ – ১৯৯৯)

• মহীনের ঘোড়াগুলি আশা অডিও থেকে প্রকাশিত তাদের সম্পাদিত এ্যালবাম ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ নিয়ে ফিরে আসে ১৯৯৫ সালে। এ্যালবামটিতে তাদের সাথে নতুন প্রতিশ্রতিশীল ব্যান্ড/স্বাধীন আর্টিস্টরা সহযোগী হিসেবে লিরিক লিখেছিলেন, সুর দিয়েছিলেন। এ্যালবামের গানগুলোঃ “পড়াশোনার জলাঞ্জলি ভেবে” (লক্ষীছাড়া) | “ধাঁধার থেকে জটিল তুমি” (গড়ের মাঠ) | “কথা দিয়া বন্ধু” (অনুপ বিশ্বাস, বাদল সরকার) | “এলো কি এ অসময়” (অন্তরা চৌধুরী) | “গঙ্গা” (ঋতুপর্ণা দাস, চন্দ্রিমা মিত্র, পরমা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীর দাস) | “আমি ডান দিকে রই” (সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়) | “আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি”(দিব্য মুখোপাধ্যায়)|”পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে” (ক্রস উইন্ডস)।

মহীনের ঘোড়াগুলির সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের একটি ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ । গানটি লিখেছিলেন,সুর করেছিলেন গৌতম এবং পল্লব আর গাওয়ানো হয়েছিলো ক্রস উইন্ডস নামের নতুন একটা ব্যান্ডকে দিয়ে। এই গানের সুর নিয়ে বলিউডের মিউজিক ডিরেক্টর প্রীতম নগরবাউল জেমসকে দিয়ে গাওয়ানো ‘ভিগি ভিগি’ নামের গানটি হিন্দি মুভি গ্যাংস্টারে ব্যবহার করেছেন।

• প্রত্যাবর্তনের পরে তাদের সম্পাদিত ২য় এ্যালবাম ‘ঝরা সময়ের গান’ আশা অডিও থেকে বের হয় ১৯৯৬ সালে। এ্যালবামের গানগুলো – “মানুষ চেনা দায়” (সুব্রত ঘোষ, বনি) | “সংবিগ্ন পাখিকূল” (বনি) | গান-মালা: (ক) “কীসের এত তাড়া” (ঋতুপর্ণা দাস, চন্দ্রিমা মিত্র) / (খ) “গাইব শুধু গান” (সুব্রত ঘোষ, বনি, ঋতুপর্ণা দাস, চন্দ্রিমা মিত্র) / (গ) “কে কে যাবি রে” (সুব্রত ঘোষ, বনি, ঋতুপর্ণা দাস, চন্দ্রিমা মিত্র) / (ঘ) “বিনীতা কেমন আছ?” (নীল মুখোপাধ্যায়) | “সারা রাত” (সুব্রত ঘোষ, বনি, নীল মুখোপাধ্যায়) | “সেই ফুলের দল” (ঋতুপর্ণা দাস, চন্দ্রিমা মিত্র) | ময়মনসিংহ গীতিকা (অনুপ বিশ্বাস, বাদল সরকার) | “তোমায় দিলাম” (সুব্রত ঘোষ) | “আমার প্রিয়া কাফে” (গৌতম চট্টোপাধ্যায়)। ‘সংবিগ্ন পাখিকূল’ গানটি রিক্রিয়েট করা হয় এই এ্যালবামে নতুনরূপে।

• ১৯৯৭ সালে আবারো আশা অডিও থেকে বের হয় মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত ৩য় এ্যালবাম ‘মায়া’। এ্যালবামের গানগুলো – “হায় ভালোবাসি” (রাজা, বনি, ঋতুপর্ণা দাস, গৌতম চট্টোপাধ্যায়) | “যখন ধোঁয়া মেঘে” (সুব্রত ঘোষ) | “দিশেহারা যে মোর মন” (ঋতুপর্ণা দাস) | “দক্ষিণ খোলা জানলা” (ঋতিকা সাহানি, দেবজ্যোতি মিশ্র) | “কত কি করার আছে বাকি” (বনি) | “এই মুহূর্তে” (রাজা, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, বনি) | “এ কী কথা শুনি হায়” (লক্ষীছাড়া) | “ভিক্ষেতে যাবো” (নীল মুখোপাধ্যায়) | “টেলিফোন” (গৌতম চট্টোপাধ্যায়) | “যাও ছেড়ে চলে” (বনি)। ‘হায় ভালোবাসি’ গানকে নতুন ভাবে ফিরিয়ে আনা হয় এখানে। গৌতমের ‘টেলিফোন’ গানটি বাউল-ব্লুজের এক অসামান্য রূপ।

• মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত চতুর্থ ও শেষ এ্যালবাম ‘ক্ষ্যাপার গান’ ১৯৯৯ সালে কলকাতায় আসে আশা অডিও থেকেই। এ্যালবামের গানগুলো – “শোন সুধীজন” (ক্রস উইন্ডস) | “ক্রিকেট” (অর্ণব চট্টোপাধ্যায়) | “সাততলা বাড়ি” (প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়) | “বাঙ্গালি করেছে ভগবান” (গৌতম চট্টোপাধ্যায়) | “ঘরে ফেরার গান” (চন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায়) | “তাকে যত তাড়াই দূরে” (তাপস দাস) | “সবাই তো ইনসান” (অনুপ বিশ্বাস, বাদল সরকার) | “তাই জানাই গানে” (অরুণেন্দু দাস) | “পাখিদের সুরে গান” (ক্রস উইন্ডস)। এ্যালবামের ‘সুধীজন শোন’ গানটি ছিলো তাদের নিজস্ব স্টুডিয়ো এ্যালবাম থেকে রিমেক করা। আর ‘বাঙ্গালি করেছে ভগবান’ গানটি প্রচলিত সাঁওতালি গান ‘সান্তাল করেছে ভগবান’ এর বঙ্গরূপ।

উপরের সারির তিনটা এ্যালবাম মহীনের ঘোড়াগুলির স্টুডিও এ্যালবাম । নিচের সারির চারটি এ্যালবাম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত’।

মহীনের ঘোড়াগুলির জনরাঃ
মহীনরা নিজেদের কোনো নির্দিষ্ট জনরায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। রক,জ্যাজ,ফোকে(আরবান) কাজ করেছেন তারা । সবগুলোতেই তারা সাবলীল ছিলো। তাদেরকে বাউল-জ্যাজের পথিকৃৎ বলা হয়। ১৯৮০ সালের ইন্টারন্যাশনাল জ্যাজ ফেস্টিভ্যাল হয়েছিলো কলকাতায়। সেখানে তারা সুইডিশ, জার্মানসহ বিভিন্ন দেশের জ্যাজ গ্রুপের সাথে পারফর্ম করেন।

অনুপ্রেরণাঃ
দ্য বিটল্‌স, বব ডিলান, থেকে শুরু করে লুডভিগ ফান বেটোফেন, রবিশঙ্করসহ অনেকেই ছিলেন তাদের অনুপ্রেরণা। ষাটের দশক থেকে কলকাতায় গিটার বাজিয়ে গানকরা নিভৃতচারী অরুণেন্দু দাস (সম্পাদিত এ্যালবামে অরুণদার গান আছে) এবং গৌতমদের ইন্টালেকচুয়াল পাওয়ারহাউজ দীপক মজুমদার ছিলেন তাদের অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎস।

জীবনমুখী গানের ধারার আদিস্রষ্টা গৌতম চট্টোপাধ্যায় ১৯৯৯ সালে মৃত্যুবরন করেন। থেমে যায় ঘোড়ারা যদিও এখনো প্রদীপ,রঞ্জন,এব্রাহামরা যে যার মতো মিউজিকের সাথেই রয়েছেন দেশে-প্রবাসে। মহীনের প্রায় প্রতিটি এ্যালবামের সাথেই বুকলেট বের হতো। সেই বুকলেটে এ্যালবামগুলো নিয়ে বিস্তারিত লেখা থাকতো, থাকতো লিরিকও। ২০০৮ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতায় তাদেরকে ট্রিবিউট দিয়ে কনসার্ট হয়েছিলো ‘আবার বছর ত্রিশ পরে’ নামে সেখানে অর্কেস্ট্রা এবং জ্যাজের আলাদা দুটো সেগমেন্টে শ’য়ের উপর মিউজিসিয়ান পারফর্ম করেছিলেন। এরপর আরো কয়েকটি ট্রিবিউট কনসার্ট হয়েছে সেখানে কলকাতার সব মিউজিসিয়ানরা পারফর্ম করে এসেছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে গৌরব ওরফে গাবু’র (লক্ষীছাড়া ব্যান্ডের) তত্বাবধানে মহীনের সদস্যদের নিয়ে কন্সার্ট হয়েছে। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া রেডিও সাক্ষাৎকারে প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিলো মহীন সফল কিনা? তিনি বলেছিলেন- “মহীনের ঘোড়াগুলি চেয়েছিল একটা পরিবর্তন, যেটা পুরাতনকে ভেঙ্গেচূড়ে নতুন কিছু নিয়ে আসবে। এবং মহীনের ঘোড়াগুলি সেটা করতে পেরেছে!”। বাংলাদেশ এবং কলকাতায় ব্যান্ড মিউজিকে দাপিয়ে বেড়ানো অনেক ব্যান্ডেরই অনুপ্রেরণা মহীনের ঘোড়াগুলি।

আর্টিস্টঃ দময়ন্তী চক্রবর্তী

একনজরে মহীনের ঘোড়াগুলি

প্রতিষ্ঠাঃ (প্রক্রিয়া শুরু ১৯৭৪, ‘সপ্তর্ষি’ নামে প্রথম শো ১৯৭৫, স্বনামে আত্মপ্রকাশ ১৯৭৬)
কার্যকালঃ ১৯৭৬-৮১, ১৯৯৫-৯৯
জনরাঃ রক, রক-ফোক, জ্যাজ, বাউল-জ্যাজ

সদস্যঃ

গৌতম চট্টোপাধ্যায় (মনি’দা) – কন্ঠ, কথা, লিড গিটার, স্যাক্সোফোন
প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় (বুলা)- কন্ঠ, বেস গিটার
তাপস দাস (বাপি)- কন্ঠ, কথা, গিটার
রঞ্জন ঘোষাল- কথা, মিডিয়া রিলেশান
আব্রাহাম মজুমদার- পিয়ানো, ভায়োলিন, ভায়োলা
বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় (বিশু)- ড্রামস, বেস ভায়োলিন, গিটার
তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায় (ভানু)- কন্ঠ, গিটার (১৯৭৬-৭৮)
রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়- গিটার (১৯৭৮-৮১)
প্রণব সেনগুপ্ত- ড্রামস
তপন চট্টোপাধ্যায়
প্রবাল হালদার
শর্মিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়
সঙ্গীতা ঘোষাল

এ্যালবামঃ
স্টুডিও এ্যালবাম (১৯৭৭ – ১৯৭৯)
১. সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক – ১৯৭৭
২. অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব – ১৯৭৮
৩. দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি – ১৯৭৯

সম্পাদিত এ্যালবাম (১৯৯৫ – ১৯৯৯)
১. আবার বছর কুড়ি পরে – ১৯৯৫
২. ঝরা সময়ের গান – ১৯৯৬
৩. মায়া – ১৯৯৭
৪. ক্ষ্যাপার গান – ১৯৯৯

তথ্যসুত্রঃ
• এ্যালবামের সাথে প্রকাশিত ৩টি বুকলেট।
• প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, তাপস বাপীর সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা।
• নিয়ম ভাঙার ছাড়পত্র – গৌরব চট্টোপাধ্যায়।
• আবার বছর ত্রিশ পরে – ত্রিশ বছর পুর্তিতে জীবিত সদস্য দ্বারা সম্পাদিত বই।
• বাউল গৌতম – সুনেত্রা ঘটক।
• বাংলা গানের পপকাল্ট – দেবজ্যোতি মিশ্র।
• মহীনের ঘোড়াগুলি – দীপক মজুমদার।
• গৌতম – এ মুখার্জী প্রাঃ লিমিটেড, কলকাতা থেকে প্রকাশিত গৌতম স্মরণে স্মারকগ্রন্থ।
• Citybeats,Urban folk music in late-modern Calcutta – Avishek Ganguly
• Back to ’70s with Mohiner Ghoraguli – The Times of india

( লিখেছেনঃ গৌতম কে শুভ)